Tuesday, May 14, 2019

গরমের দুপুর আর ভগবানের রসিকতা


চুপচাপ বসে ছিলাম, সামনে ছড়ানো মোবাইল, ল্যাপটপ, কিছুতেই কিছু লিখে উঠতে পারছিনা, তার উপর এই গরম। মাঝে মাঝে আমার তুমুল মন খারাপ হলে ঘুম পেয়ে যায়। এই গরমে সেই সুখ নিদ্রাও কপালে নেই। বলছে নাকি বৃষ্টি হবে! এই সব ভাবছিলাম, মনে হল যেন মেঘ করে এল। ভাবলাম যাক একটু ঠান্ডা হবে পরিবেশটা, হঠাৎ কাঁধের উপর একটা ছোঁয়ায় চমকে উঠলাম।
- আপনি?
একটা আনমনে স্মিত হাসি হেসে খানিকটা যেন শুন্যের উপরেই বিরাজমান হলেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। গরমকালের জন্য কিনা কে জানে, ওরকম দাড়ি, জটা সমেত ঋষিকে দেখে আমিও এক মুহুর্তের জন্য ভয় পেয়ে গেছিলাম। তারপর দেখলাম দাড়ির শেষের দিকটা দিয়েই একটু কপাল টপাল মুছে নিয়ে বললেন,
- পাপে ভরে গেছে হে, তাই ভানুদেবের এরকম রুদ্রমূর্তি।
বলে একটু চুপ করলেন, আমি ভাবছি কি বলব? আপ্যায়ন করার মত আমার কাছে কিছুই নেই, চা বা কোল্ডড্রিঙ্কস তো আর এত বড় একজন কে অফার করা যায়না।
- মাথায় যখন আসছেনা, তখন চলো তাহলে একটু বেরিয়ে আসি...
আমার মনে পড়ল, বউ বলেছে বিকেলে বাজার করতে হবে, তাই আমতা করে বলতে গেলাম,
- ইয়ে, আবার মহেন্দ্র পর্বতে নাকি? আমার আবার...
- আহা, সময় তো পালাচ্ছে না, আর এবার মহেন্দ্র পর্বতে যাব না।
- তাহলে?
- আহ! চলোই না, ঘুরতে ঘুরতে কথা বলা যাবে।
বলেই এগিয়ে এসে আমার হাতটা খপাৎ করে ধরলেন, মনেহল কিরকম যেন শরীরটা পাকিয়ে কোথায় ঢুকে গেল, আর কি বিশাল বড় হাতের পাঞ্জা! হাতের মুঠোটা একটু আলগা হতেই দেখলাম বিরাট এক ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আমি। চারিদিকে বিশাল বিশাল আকৃতির মানুষ সব। মানুষ বলেও ঠিক মনে হচ্ছেনা, কারুর উচ্চতাই ৭/৮ ফুটের কম নয়, সবারই উর্ধাঙ্গ মোটামুটি উন্মুক্ত। প্রথম ঝটকায় ভাবলাম আমায় বুঝি খোক্কস পুরীতে নিয়ে এসেছেন ব্যাসদেব। একটু ঠাহর করতে বুঝলাম, এরা মানুষই, বেশ সৌম্য গড়ন, গা লোমে প্রায় ঢাকা, তাই দেখতে একটু বন্য লাগছে।
-এরা কারা? আমরা কোথায়?
ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, উত্তর এলো,
- কিষ্কিন্ধ্যা
উনিও উত্তর দিয়েছেন আর আমারও চোখ পড়েছে এক মহিলার দিকে, মহিলার পোষাক একটু অন্যরকম কিন্তু যে কোনো পুরুষের মনে ঝড় তোলার জন্য যথেষ্ট। ধাঁ করে, লীলা মজুমদারের লেখা 'লঙ্কাদহন পালা'-র হনুমানের ডায়লগ মনে পড়ে গেল,- ' ছ্যা, ছ্যা! এরকম সুন্দরী তো আমাদের কিষ্কিন্ধ্যার রাস্তায় গড়াগড়ি খায়', কতকটা এরকমই ছিল। আচমকা একটা টানে আমি একটু সরে এলাম।
-ঐ দেখো!
তাকিয়ে দেখলাম ঠিক আমাদের পিছন থেকে একজন বিশালদেহী লোক এসে, ফটকের সামনে দাঁড়ালেন, হাতে একটা ইয়াব্বড় একটা কাস্তের মত বিশাল একটা অস্ত্র। ওখানে দাঁড়িয়েই একটা বিশাল আড়মোড়া ভেঙ্গে এক প্রহরীকে বললেন,
- মারুতি কি অন্দরমহলে আছে?
প্রহরী যেন খুব চেনে লোকটাকে এইভাবে এক লম্বা প্রণাম করে তাকে ভিতরে যেতে দিল।
-চলো
আবার হাতে টান পড়ল। যেতে যেতেই জিজ্ঞাসা করলাম,
- কোথায় যাচ্ছেন? লোকটা কে?
- ভিতরে। উনি, কৈকষী পুত্র দশানন।
- রাবন?
- নাহ, ও নামটা পাননি এখানে।
কিচ্ছু বুঝতে পারলাম না, শুধু পিছন পিছন গেলাম। জায়গায় জায়গায় অসাধারণ সব ভাস্কর্য্য, এদিকে ঝরনা, সামনে এক জায়গায় ছোট্ট জলাশয়ের মধ্যে রং বেরঙের মাছ। এক জায়গায় গিয়ে দশানন দাঁড়িয়ে পড়ল। এতবড় চেহারা সামনে কি হচ্ছে দেখার জন্য উঁকি মারতে হয়। দেখি হুবহু একই রকম দেখতে দুজন বসে দাবা খেলছে, একজনের উত্তরীয় হলুদ আর একজনের লাল। দশানন দাঁড়িয়ে যেতে হলুদ উত্তরীয়র মালিক মুখ তুলে তাকিয়ে বলল,
-মহারাজ ভিতরে আছেন।
বলেই, অপরজনের দিকে সন্দিঘ্ন ভাবে তাকিয়ে বলল,
- আবার চাল পালটে দিলি নাকি?
- না, না! আমি কিচ্ছু করিনি।
- মনে হল যেন, তোর হাতটা নড়ে উঠল।
ঝগড়া যেন লাগব লাগব করছে, ক্রমশ দুজনের শরীর যেন ফুলে উঠছে,
- এই জন্য তোর সাথে খেলতে আমার ভালো লাগেনা
- হেরে যাচ্ছিস বলে এখন তুই ছুতো খুঁজছিস।
- তুই দাবা খেলতে পারিস?
লোম টোম একেবারে খাড়া হয়ে আসছে। দশানন একটু হেসে বললেন,
- সুগ্রীব, আমি দেখেছি, বালী কিছুতে হাত দেয়নি।
হলুদ উত্তরীয়, মানে সুগ্রীব খানিকক্ষণ দশাননের দিকে তাকিয়ে বলল,
-ঠিক বলছ? রসিকতা করছ না তো?
- ছি! ছি! মহারাজ মারুতির প্রধান দুই দেহরক্ষীর সাথে আমি রসিকতা করব?
- শোন, তুমি রাক্ষস যোনিসম্ভব হলেও, ব্রাহ্মণ সন্তান বলে আমি তোমার কথা মেনে নিলাম।
বলেই খেলায় মন দিল, আমরা এগিয়ে চললাম। এক প্রকান্ড দরজা খুলে দশানন একটা ঘরে ঢুকল। উফ! কি বিশাল ঘর। চারিদিকে দারুণ সব ভাস্কর্য্য, তৈলচিত্র, মাঝখানে এক দারুণ গদি পাতা, তার সামনে রাখা নানারকম খাবার আর মদ। মদই হবে বলে মনে হল। মাঝখানে বসে আর এক বিশাল দেহী আর তার দু পাশে বসা অসধারণ কয়েকজন সুন্দরী। দশানন ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ঘরের ভিতরের পুরুষটি তার পাশের সুন্দরীদের সাথে পাশা খেলছেন আর হাল্কা মজা করছেন বলেই বলেই মনে হল।
- দাঁড়িয়ে কেন? এস একটু দ্যূতক্রীড়ায় অংশ নাও।
দশাননের উদ্দেশ্যে বললেন সেই বিশালদেহী। দশানন আরো একটু অপেক্ষা করে বললেন-
- না, মারুতি, আজ একটু মল্লক্রীড়ার উৎসাহ হচ্ছে। তোমার কি আজ তেমন মতি নেই?
- না না, নিশ্চয়ই তোমার আশা পূরণ হবে দশানন, তবে একটু সুরা পান করে নাও, মত্ত অবস্থায় মল্লক্রীড়ায় আলাদা আমেজ আসে।
দশানন একটু হেসে এগিয়ে গেলেন।
সব দেখেশুনে আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না, বললাম,
- কি হচ্ছে বলুন তো?
অল্প হেসে ঋষি বললেন,
- রামায়ণ হে! তবে তোমার পড়া মত নয়। কিষ্কিন্ধ্যার রাজা এখানে হনুমান, ঐ যে...
বলে ঘরের মাঝখানে বসা, শ্বেত উত্তরীয় পড়া পুরুষটিকে দেখিয়ে দিলেন ব্যাসদেব।
- আর এই মহিলারা?
- রাজ মহিষীগণ।
- বাপরে এসব কি সত্যি নাকি?
- এটা হচ্ছে তোমাদের হিসাবে সেই সময় যখন রাবণ ত্রিলোকবিজয় করতে বেরিয়ে বালীর কাছে নাকানি চোবানি খেয়েছিল।
-আর এখানে?
- দেখতেই তো পাচ্ছ, বালী এখানে রাজাই হয়নি। রাজা নির্বাচনের সময় দুই ভাইকে একাই মারুতি হারিয়ে দেয়।
- তাহলে রাম কি করবে? কাকে নিয়ে খুঁজতে যাবে?
একটা অদ্ভুত হাসি হাসলেন ব্যাসদেব। রামায়ণ লেখা হয়নি এখানে।
- মানে? কি বলছেন?
এদিকে দু পাত্তর সুরার পর দশানন আর হনুমানের মধ্যে ধুন্ধুমার মল্ল যুদ্ধ লেগে গেছে। ভাবছিলাম দেখি একটু কিন্তু ব্যাসদেব বললেন চলো আর একটু অন্য জায়গায় ঘুরে আসি। আবার হাতে টান আর আমি কোথায় যেন সেঁধিয়ে গেলাম।
পা মাটিতে ঠেকতে দেখি এক ঘন জঙ্গল।
- কোথায় এলাম?
- জায়গাটা ঠিক জানিনা। শুধু দেখে যাও।
দেখলাম, দুই বুড়ো মত লোক একজন তো সাদা দাড়িগোঁফ নিয়ে রীতিমত বৃদ্ধ আর একজন প্রৌড় তবে চুল পাকেনি একটু কাছে আসলে মনে হল দাড়ির বার দ্বিতীয়জনের যেন বেশ একটু কমের দিকে। আরো একটু কাছে আসতেই, পিছনের জঙ্গল থেকে দস্যু মত একজন আচম্বিতে বেরিয়ে এল, একহাতে তার একটা দড়ি মত জিনিস আর এক হাতে ভোঁতা একটা অস্ত্র।
- যা আছে সব বের করে দাও।
- কে তুমি বাছা? আমরা তীর্থ ভ্রমণকারী আমাদের কাছে অর্থ করি কিচ্ছু নেই।
- ওসব বলে লাভ নেই। কিছু না থাকলে মৃত্যূ অবধারিত।
- আমার মত একজন বুড়ো মানুষকে অকারণে মারলে, তোমার কি কিছু সুবিধা হবে?
- দেখ বৃদ্ধ, দস্যু রত্নাকরের কাছে এসব তত্ত্বকথা বলে কোনো লাভ নেই।
এই অবধি শুনেই আমি ছটফট করে উঠে বললাম,
- এতো বাল্মীকি! এবারই তো সেই 'মরা মরা' গল্পটা হবে?
- আহ! উত্তেজনার মুহুর্তে, বালখিল্যতা করোনা। চুপচাপ দেখো কি হয়।
দেখতে থাকলাম, দুই বৃদ্ধর সামনে অস্ত্র হাতে দস্যু রত্নাকর।
- তা রত্নাকর, বলছিলাম নিরপরাধ, নিরস্ত্র ব্রাহ্মন কে মেরে যে পাপ হবে তার দায় কে নেবে? তুমি অর্থ নিয়ে কি করবে?
- অর্থ নিয়ে খাদ্য কিনব, বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা মা আছে, স্ত্রী, দুই সন্তান আছে তাদের কে খাওয়াবে? এখানে কোনো কর্মের সন্ধান নেই, চারিদিকে অরাজকতা, এখানে পাপ পূন্যের কথা ভাবার এত সময় নেই বুঝলে।
- তাহলে তোমার আসল উদ্দেশ্য খুন্নি বৃত্তির নিবারণ।
একটু যেন ভেবলে গেল রত্নাকর। বৃদ্ধ আবার বললেন,
-দেখ রত্নাকর, নানা দেশ ঘুরে আমি অনেক কিছু জেনেছি। তুমি যদি চাও তাহলে তোমার খাওয়া পড়ার একটা উপায় হতে পারে। তবে তার দুটো রাস্তা আছে।
- কি উপায়?
- প্রথমটায় একটু সময় লাগবে কিন্তু তারপর গোটা ইতিহাস তোমায় মনে রাখবে। এই হল আমার পুত্র নারদ। এ তোমায় কিছু পরাশুনা শেখাবে তারপর তোমার খাওয়া পড়ার চিন্তা তোমায় করতে হবেনা।
- আর দ্বিতীয় রাস্তা?
- দ্বিতীয়টা একটু সোজা, এখান থেকে কিছু দূরে অযোধ্যা নামে রাজত্ব আছে। রাজার নাম দশরথ। তার একজন গুপ্তচর দরকার। আমার সাথে পরিচয়ের সুবাদে আমার নাম করলেই সেখানে গুপ্তচরের পদ তোমার পাকা হয়ে যাবে।
- কি নাম আপনার?
একটু হেসে বৃদ্ধ বললেন,
- ব্রহ্মা।
- আমি তাহলে ঐ দশরথের কাছেই যেতে চাই।
- তাহলে ইতিহাসে বিশেষ আগ্রহ নেই বলছ?
- নাহ।
- তবে তাই হোক। তথাস্তু।
আমি তো পুরো হতবাক।
-এটা কি হল?
- কেন? কি হল?
- যে লোকটা রামায়ণ লিখবে, সে লোকটা গুপ্তচর হয়ে জীবন কাটিয়ে দেবে? যে লোকটার ত্রিলোকের ত্রাস হওয়ার কথা ছিল সেই লোকটা শুধু কুস্তি লড়ে আনন্দ পাবে? আর যে লোকটা্র সাহস আর ভক্তির প্রতীক হওয়ার কথা সে লোকটা ফুর্তি করে বেড়াবে?
- এটা তোমার পৃথিবী নয়, এখানে এটাই সত্যি।
- আমি যদি একটা রামায়ণ এনে পড়িয়ে রত্নাকরকে উদবুদ্ধ করি?
- তাতে করে কিছুটা পরিবর্তন হবে তবে সামগ্রিক বিশাল কিছু পরিবর্তন করতে তোমায় দেওয়া হবেনা। কেন তোমাদের চিন না কোথায় যেন এক বানর রাজার গল্প আছেনা, যে নাকি দারুণ দুর্বিনীত ছিল, শোনা যায় নারী সঙ্গেও নাকি আগ্রহ ছিল।
- তাহলে, রামের বনবাসের কি হবে?
- একটু বাস্তবমুখী হও হে। গল্প লিখতে পারা যাবে এমন জিনিস জানাই ভাল। ওদিকটা বাদ দাও। তারপর তোমার বাজার আছে...
আমি কিছু বলতে যাওয়ার আগেই হাতে চাপ পড়ল আর আমি সেঁদিয়ে গিয়ে নিজের বাড়িতেই উঠলাম।
- আজকের মত চলি হে।
- কিন্তু এসব কি? আমাকে দেখালেন কেন?
- আরে বাবা, রসিকতা কি শুধু তোমরা করতে পারো, ভগবান কি একটু করতে পারেন না?
এর আর আমি কি উত্তর দেব? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি মাত্র পাঁচ মিনিট হয়েছে। ঘুমাই যে নি তার স্পষ্ট প্রমাণ আবার চেয়ারটা বেশ গরম রয়েছে। খালি আক্ষেপটা হল মল্ল যুদ্ধে কি ফল হল সেটা চাক্ষুষ করতে পারলাম না!

No comments:

Post a Comment

কুলের আচার ও পুরাতনী চিঠি

 মনে করুন, এভাবেই সময় চলছে... তাতে তো আর জীবন কাকু থেমে থাকবে না। এগিয়েই যাবে। মনে করুন এরকম ভাবেই ২০২৫ এর বসন্ত এসে গেছে, এভাবেই ঘরে বসে কা...