Thursday, September 27, 2018

মন খারাপের রাতে


এক দিন সকালে উঠে পেঁজা মেঘেদের ভেসে যেতে দেখেও আনন্দের মন কেমন করে। সুখ আর দুঃখ যমজ ভাইয়ের মত। এই হয়ত একটা বই তুলে গন্ধ নিলুম, মনটা দারুন ভাল হয়ে গেল, দু পাতা পড়ে মনে হল আমি কেন অমুক হলাম না, আমি কেন সুর বুঝিনা, আমি তো এলিয়টের সাথে ভেজা বিকেল কাটাইনি, আমি সংস্কৃত টা শিখতে পারিনি, ব্যস মনখারাপ।
এগুলো অনেক স্থূল কারণ মশাই, এগুলো আসা যাওয়া করে, কিছু কারণ আবার গেড়ে বসে থাকে যেতে চায়না মোটে। যেমন ধরুন এক রাতে ফেসবুকে ভাবলাম কোনো এক সুন্দরীকে কবিতা শোনাবো (আমার নিজেকে এভাবেই উদ্বুদ্ধ করতে হয়), কিন্তু সে এলোনা, মানে কবিতা। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে টুকি দিতে থাকল, এরকম সময় বেবাক মন খারাপ হয়।
এরকম মাঝে মাঝে হয় আমার, কখনও সামলে নিই আর খুব ঝামেলা হলে ঘুমিয়ে পড়ি। এই দেখুন না একটা রূপকথার উপন্যাস লিখব বলে খুব হেঁইও বলে লেগেছি। ভেবে রেখেছি নায়কের একটা প্রেম হবে, ছোটদের মত নয় বড়দের মত। এযাবৎ রূপকথায় যা বলা যেত বলে আমি মনে করেছি কিন্তু যা বলা হয়নি তা আমি বলব থুড়ি লিখব ভেবেছি। 
ঐ অবধিই রোজ রাতে বসি ল্যাপটপে মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের সাদা পাতা সাদাই থাকে। এ এক অদ্ভুত অবস্থা।
সেদিনও ঐ একই অবস্থায় ছিলাম, ঘুম আসব আসব করছিল, লেখা আসছিল না, হঠাৎ শুনলাম একটা অদ্ভুত গলা বলে উঠল, "তা দাওনা হে শঙ্খমালার সাথে লালকমল এর বিয়েটা দিয়ে দাওনা"। গলাটা অঞ্জন দত্তের গলার সাথে একটা স্যাক্সোফোনের আওয়াজ মিশেল দিলে যা হয় তাই। অবাক কাকে বলে! যে প্রাণীটা দেখলাম তার বিবরণে পরে আসছি। সানাইয়ের সুরের সাথে যদি লাবণী সরকারের গলা মিক্সিতে ঘন্ট পাকিয়ে দেওয়া হয় তাহলে যা দাঁড়াবে, সেই গলার এক মহিলা স্বর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, "কেন কেন, লালকমল কেন? নীলুর সাথে শঙ্খর বিয়ে হবে"। 
-
যা বোঝনা তা নিয়ে কথা বলোনা ব্যাঙ্গমী, নীলু ওরকম একটা স্টাড, ওর সাথে যাবে হল কাঞ্চনমালা।
চোখের সামনে, শ্রাবন্তী আর কল্পনার সুপ্রিয়াদেবী ভেসে উঠলেন। চোখ ফেরাতেই দেখি লোকটা প্রায় নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে বলছে, "সিনেমাটা তো হলনা। এবার এটা কর, যদি পার। প্রায় তিন খানা কম্পাঙ্কের স্তর পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমাদের, আর আমরাই শেষ লটের শেষ কাপল এর পরে আর ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী ম্যানুফ্যাকচারর্ড হয়নি"।
    ভাবছিলাম বলি, তা আপনারা যদি একটু চেষ্টা চরিত্তির করতেন তাহলে কি এক আধটা... ভাবনা পুরো শেষ করার আগে একটা অন্য গলা পেলাম, - "নিজের কথা গুলোই বলে যাবে? আমিও অনেক দূর থেকে এসেছি"- কাঁসরে যদি ফাঁপা কাঠি দিয়ে মারা হয় তাহলে যে শব্দ বেরোয় তার সাথে কৌশিক গাঙ্গুলীর গলা মেশাতে হবে। সে বলল, “আমি নিজেই পরিচয় দিচ্ছি। আমি হলুম ভূশণ্ডী, আদি বায়স কুলচূড়োমণি, দন্ডবায়স
- “
হু:, দাঁড় কাক! আরে বাবা পাখি হিসাবে তুমি আমার নখের যুগ্যিও নও ব্যাঙ্গমা একটা বিকৃত মুখ করে ঝাঁঝিয়ে বলে উঠল।
-“কিন্তু ঐ ব্যাপারটা শুধু বাদ দিলে, ঐতিহাসিক বল, কিংবদন্তি বল, সাহিত্য মর্যাদা বল, আমি কম নই, বরং আমার রেঞ্জটা একটু বেশি”, ভুশন্ডীর মিচকে জবাব।
একটু দমে গিয়ে ব্যাঙ্গমা বলল, - “সে দক্ষিণারঞ্জন ছাড়া আর কেউ সাহস করল না, ত্রৈলোক্যবাবুও চাইলে পারতেন কিন্তু করলেন না...”
-
তাই এই ছেলেটাকে ধরলে?
-
আরে বাবা, একটা জিনিস তো বুঝতে হবে আমি কিছু করিনি ও নিজেই চেয়েছে, নাহলে এমনি এমনি...
-কে জানে বাবা এমন কুচুটে লোকের এখানে কি দরকার কে জানে, কথা হচ্ছিল শঙ্খমালা নিয়ে...”, গজগজ করতে করতে ফুট কাটল ব্যাঙ্গমী।
    এতে দেখলাম একটু চোখ পিটপিট করে ভুশন্ডী খানিকক্ষণ থমকে গেল, যেন একথার উত্তর আর সে দিতে পারবেনা, তারপর একটু সাম্লে নিয়ে বলল,ও যেটা বলতে আসা এখানে। আসার পথে দেখলুম কঙ্কাবতী বনের পথে আসছে, তা বলছিলাম এমনি সে ডাগর হয়েছে, তারপর তোমরা যখন নীলকমল এর জন্য পাত্রী খুঁজছ...”
“না, না” করে ব্যাঙ্গমা এক চিৎকার করে উঠল, “আরে বাবা টাইম আর স্পেস নিয়ে মশকরা করিসনা, ভুশন্ডী, গোটা প্লটটার একটা জগাখিচুড়ি পাকিয়ে যাবে”।
-“কেন এরকম কি হয়না?” –একটা মিহি গলা যেন ফুট কাটল পাশ থেকেএকটা নেড়া মাথা, গলাবন্ধ জরির পাঞ্জাবী আর চোস্ত পরা একটা লোক, মুখে একরাশ লজ্জা মেশানো ভাব আর হাতে কিছু কাগজ নিয়ে লোকটা বলল, “আমি তো হামেশাই এরকম মিল দেখতে পাচ্ছি। এই ধর খুঁজছিলাম একটা লালমুখো হুমদো বেড়াল কে, হঠাৎ এখানে এসে হাজির হলাম। তা একটা কবিতা শুনবে, কবিতা...”, বলে কারুর তোয়াক্কা না করে একটা পাকানো কাগজ খুলে পড়তে আরম্ভ করে দিল,
“লাল গাছে নীল ফুল
 সোঁদা সোঁদা গন্ধ,
 কি যে হয়, কোথা যাই
 মনে লাগে ধন্ধ...
তারপর...তারপর...” বলে সে খুব খুঁজতে লাগল কাগজটায় তারপর কিছু খুঁজে না পেয়ে একটা বোকার মত হেসে বলল, “আজকাল চার লাইন করে লিখছি”। কথাটা বলে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচাতে লাগল, কবিতার প্রশংসা পাওয়ার আশায়।
ব্যাঙ্গমা প্রচণ্ড এক ভুরু কুঁচকে ভূশন্ডীকে বলল, “কাকেশ্বর, তুমি আবার এদের ঢোকালে?”
ব্যাঙ্গমী সঙ্গে সঙ্গে নাকি কেঁদে বলে, “তাহলে আমাদের নীলুটার কি হবে গো, রাক্ষসী রানী যদি ওকে কাঠালের বিচি বানিয়ে রাখে?”
-“আঃ মেলা বকোনা তো এখন, দেখতে পাচ্ছ ইনসেপশন হচ্ছে”, বলেই আবার ভূশন্ডীকে বলল,  কি, কী হল কাকেশ্বর?
ভূশন্ডী দেখলাম তাতে খুব মুখভার করে বলল, “না না, খুড়ো, ওই নামে এখন আর আমায় ডাকলে চলবে না। আমি আর ঐ হিসাবের ব্যবসা করিও না আর হিসেব রাখিও না। এখন আমি যাকে বাংলায় বলে, স্পিরিচুয়াল মোটিভেটর”
-ইল্লি আরকি! তা পাখিদের আর কাজ কি, টপ ভিউটা কি এমনি এমনি দিয়েছে? আর তাছাড়া গরুর আর জটায়ু ছাড়া কোন পাখীকে তুমি অ্যাকশন করতে শুনেছ শুনি?
দুজনের কথা চলছিল, হঠাৎ মাঝখানে সেই সরু গলা ব্যাঙ্গমী কে বলল, “তা বলছিলাম কি, আপনি আমার একটা কবিতা শুনবেন?”।
ব্যাঙ্গমী তো একলাফ দিয়ে উঠে বলল, “আ মোলো যা! কি অলক্ষুণে কথা বলে শোনো”
-“আহা, একবার শুনেই দেখুন না, কতদিন কেউ ভুল করে আসে না এদিকে, আর ব্যাকরণ শিং ও একেবারে বেপাত্তা। এটা একেবারে নতুন...
 ‘চেপেচুপে একখানা আঁক কষ মাথাতে,
 কে বা বড় সিংগি না গজরাজ বনেতে?
 হিসাব নিকাশ যদি মিলে যায় মনেতে
 কি আর করা যাবে তালি মারো দু-হাতে’,”।
বলে নিজেই একেবারে খুব আহ্লাদে গদগদ হয়ে উঠল।
ব্যাঙ্গমা আরো ক্ষেপে গেল, “কাকেশ্বর, এটা কি হচ্ছে?”
কাকেশ্বরের অম্লান বদনে জবাব, “কি আর হবে? হিজিবিজবিজ এর ইচ্ছা থাকলেও কিছু হবে না, যদিও আইন বেরিয়ে গেছে, আর আপনিও কিস্যু করতে পারবেন না। তবে আর একবার ও নামে ডাকলে কিন্তু লোক লেলিয়ে দেব বলে রাখছি।
আমাকে আইনের ভয় দেখাচ্ছিস? জানিস আমার ডিরেক্ট ব্লাড লাইনে কার কার নাম আছে? আর লোকের ভয় দেখাচ্ছিস? জানিস একটা ফোন করলে নীলু চলে আসবে তারপর রক্তগঙ্গা বইবে”।
কাকেশ্বর ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলল, “সে যার রক্তে যা থাকে থাকুক কিন্তু ও নামে ডাকলে আমি মোটেই খেলব না”
-   “কাকেশ্বর! কাকেশ্বর! কাকেশ্বর!”
-   “উবু! একষট্টি, বাষট্টি, তেষট্টি...”
কাকেশ্বর এরকম বলতে বলতেই দুটো টেকো লোক মাটি ফুঁড়ে যেন উদয় হল।
প্রায় একরকম দেখতে লোকদুটোকে কার্টুনের মত, লম্বা দাঁড়ি হাঁটু অবধি ছুঁয়েছে, একজনের কপালের পরেই একগাছি বেগুনী চুল আর একজনের সেটাও নেই, বোজার সুবিধের জন্য বোধহয়। দুজনেরই পড়নে হাফ প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি।
একদম টেকোটা বলল, কতবার না বলেছি, দুপুরবেলা অঙ্ক কষতে ডাকবে না, পান্তাভাতে পিঁয়াজ মেখে খেয়ে আমরা দুজন ঘুমোই।
কাকেশ্বর অপ্রস্তুত হয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “কতবার বলেছি সে ব্যবসা আর করিনা আমরা, বুধো, গাঁট্টা মার উধোটাকে”।
যাকে বুধো বলে ডাকা হল, সে বলল, “সে তুমি যাই বল, এখনও তিন টাকা চোদ্দ আনা ছয় নয়া পয়সার হিসাব বাকী আছে, সেটা না দিলে কাজ করব না”।
বেগতিক দেখে কাকেশ্বর গলা নামিয়ে বলল, “আরে দেবো দেবো খাতায় সব লেখা আছে না। কিন্তু এ লোকটা যে তোদের টেকো বলল সেটার কি হবে?”
একথা শুনেই দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে, “আমাদের টেকো বলেছে রে!” বলে সুর করে ডেকে উঠল, তারপর রাগে মাটিতে পা ঘষতে লাগল।
এদিকে ব্যাঙ্গমা ঘাবড়ে গিয়ে, “এই মারবি নাকি? এই... নীলকমল এসে পড়বে কিন্তু...খবরদার বলছি...”, এসব বলতে লাগল। আর ব্যাঙ্গমী, “আমার কি হবে গো”, বলে কাঁদতে আরম্ভ করেছে। হিজিবিজবিজ এসব দেখে, “আমার কি হাসি পাচ্ছে গো”, বলে গা দুলিয়ে হাসতে লাগল। কাকেশ্বর শুধু, “লেগে যা, নারদ নারদ”, বলতেই, উধো আর বুধো তেড়ে গেল।
মাথাটা ল্যাপটপের উপর ঠোকা লেগে যেতেই, তাকিয়ে দেখলাম সাদা ওয়ার্ডের পাতায় দু লাইন লেখা আছে-
“হিং টিং ছট,
 কাগের বাসায় বগের ডিম,
 তোড়ায় বাঁধা, ঘোড়ার ডিম”।

কুলের আচার ও পুরাতনী চিঠি

 মনে করুন, এভাবেই সময় চলছে... তাতে তো আর জীবন কাকু থেমে থাকবে না। এগিয়েই যাবে। মনে করুন এরকম ভাবেই ২০২৫ এর বসন্ত এসে গেছে, এভাবেই ঘরে বসে কা...