Wednesday, July 18, 2018

একটি পরিকল্পিত হত্যা কাহিনী-২


চন্দন নিজের মনেই যেন বলে চলল, ‘ফিলিম মানে আপনাদের যদি মনে ধরে তাহলে, নইলে এমনি শুনতে পারেন। আসলে দুপুরে আপনাদের কথা শুনে... আর তারপর এই গল্পটা আপনাদের বলবো বলে বেগ এসে গেল...’ এই অবধি বলে লোকটা একটা পজ নিল, যেন আমরা বারণ করলে আর বলবে না। আমাদের মশাই গল্পের ভান্ডার তবু তার অনেক প্যাখনা আছে, কার রাইট, কে কিনে রেখেছে, লেখক বেঁচে আছে কিনা, থাকলে তিনি দিতে চাইলেও তার স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, জামাতা আপনার ক্রিয়েটিভিটি মেপে দেখার চেষ্টা করবে, তারপর আছে প্রোডিউসার নামক এক অদ্ভুত জীব যিনি সব কিছু ইউনিক চান আবার যা বাজার চলতি তার গন্ধ থাকতে হবে, এ এক বিস্তর হ্যাপা, তাই রাস্তা ঘাটে, আদারে-বাদাড়ে, ডাস্টবিনের ধারে গল্প পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ি। তারপরে এমন চাঁদনী রাত, গল্পটা খারাপ হলে ঠিক কাটিয়ে দেবো আর ভাল হলে তো কথাই নেই।
‘আমি এখানকার লোক নই’, এই বলে আবার শুরু করল চন্দন, কোথাকার লোক সেটা উহ্য রেখেই বলল, -“আমার যখন ১৭ বছর বয়স, তখন আমার মা মারা যায়, আমার বাবা আবার এমনিতে খুব দরিয়া মেজাজের লোক ছিল বুঝলেন, দোষের মধ্যে রোজ একবার করে গলা অবধি মদ খেত তাতে সে মাতলামি করতনা কিন্তু তারপরেই তার শরীর জেগে উঠত। এই করে করে আমরা ন’ভাই বোন হলাম। গুণের মধ্যে বাপ আমার, মায়ের মধ্যেই শায়রা বানুকে খুঁজে পেত, তবে মায়ের শরীর দিন দিন ভাঙতে লাগল।আমি আর আমার এক বোন এই দুজন একটু স্কুলে পড়তে পেরেছিলাম, বাকীদের সে সুযোগ আর হয়নি। মা মারা যাওয়ার পর বাবার মেজাজ খারাপ হতে লাগল, কাজে যেতনা, দিনরাত আমাদের খিস্তি করত, এদিকে আমাদের পেটে ভাত নেই। আমি বুঝতে পারছিলাম পেটে মদ পড়লে বাবার চরিত্র পালটে যায়, অথচ বাইরে যাবার সাহস আর পয়সা দুটোই নেই। আমার চেহারাটা ছোট থেকেই বড় সড় ছিল বলে আমি ফাইফরমাস খাটা, মাল বয়ে দেওয়া এসবের কাজ পেতাম তবে আমি বুঝতাম এসব ছোট কাজে আমার পোষাবে না। বাবা আমার ঐ চেহারার জন্য আমায় কিছু করতে পারতনা, কিন্তু ছোট ভাই-বোন গুলোকে কারণে অকারণে মারত। আমি নিজের মধ্যে একটা রাগ টের পেতাম। একদিন আমার বাপ, আমার সামনেই আমার ১৫ বছরের বোনকে সপাটে চড় মারল আর বেশ্যা বলে গালি। সামনে আমার একটা মাটি কাটার কোদাল পড়েছিল, কান গরম হয়ে গেল আমার, মায়ের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল, বেরিয়ে চলে গেলাম। সেদিন প্রথম আমি মদ খেলাম, কিছুই বুঝলাম না আমি, নেশাও সেরকম হল বলে মনে হলনা। আমি বাবার জন্য বুঝলেন, রোজ আর বাড়ি ফিরতাম না, কিন্তু সেদিন ইচ্ছা হল বাড়ি ফেরার খিদেও পাচ্ছিল খুব। বাড়ির উঠোনে পা দিতেই একটা চাপা চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ এল। আমার ছুটে যেতে ইচ্ছে হল কিন্তু কেন জানিনা আমি পা টিপে টিপে পিছন দিক দিয়ে গেলাম। সেই রাতে আমি আমার বাবার মাথা থেঁতলে দিয়ে মেরে ফেলেছিলাম”- এই অবধি বলে একটু থামল চন্দন একটা বিড়ি ধরাবে বলে। রাত কত হল আমাদের খেয়াল নেই, আমি আমি বছর ৪০-র ফ্ল্যাশব্যাক থেকে ফিরে এসে দেখি, সবাই খুব জমে গেছে চন্দনের চারপাশে। চাঁদের আলোয় সবাইকে অল্প অল্প দেখাযায়, সবাই নেশাতুর, সবাই মগ্ন।
বিড়ি তে দুটো টান মেরে আর এক চুমুক মদ খেয়ে চন্দন আবার শুরু করে দিল- “মনের রাগ ইচ্ছে মত ঝেড়ে ফেলতে পারলে একটা অদ্ভুত আনন্দ হয়, আমি যতবার কাউকে মেরেছি, সে ঘুষি, লাথি, ছুরি যাই হোকনা কেন নিজেকে ততবার বেশি করে মানুষ মনে হয়েছে, শুধু একবার ছাড়া। বাবাকে মেরে ফেলার পরই বুঝলাম আমি আর গ্রামে থাকতে পারবনা, বোনের দিকে তাকাতে সে-ও যেন নীরবে তাই বলল। ভাইবোন গুলোকে এমনিতেও খাওয়াতে পারব কিনা জানতাম না, আমার মনে কোন পাপ বা ভয় কাজ করলনা আমি সেই রাতেই একটা মেল ট্রেনে উঠে পড়লাম। কলকাতায় চলে এলাম, তারপরের চারবছর আমি বাড়ির চাকর থেকে, মিথ্যে সাক্ষী, মেয়েমানুষের দালালি সব করেছি কিন্তু চুরি করিনি। এত করেও আমার কিছুই ভাল লাগছিল না, আমি অনেকবার মেয়েদের কাছ থেকে সুযোগ পেয়েছি কিন্তু তাতেও আমার মন যেতনা, মেয়েদের আমার ভালোলাগত না, কেন জানি। এই সময় একটা লোকের সাথে আলাপ হয়, নাম সুবল। সে নাম বলত সুবোল। এই সুবোল বড়লোকের ছেলেদের নেশার জিনিস যোগাত, গরীবদের ও দিত তবে সাথে উপদেশ উপরি থাকত আর গরীবদের কাছে দামটা একটু কম নিত। আমাকে কেন জানিনা সুবোল খালি নেশা না করার কথা বলত, আমি অবশ্য নেশা করে সেসময় বিশেষ আরাম পেতামনা বলে ঝোঁক ছিলনা খুব একটা। একটা কথা বলে রাখা ভাল, কিকরে যেন আমার বাংলা ভাষাটা ভাল লেগে যায়, আমি মাঝে একটা বই এর দোকানে মোট বয়েছিলাম, বাইন্ডিং-এর কাজ শিখেছিলাম, তারপর কাজ ছেড়ে দিয়েও সেখানে গিয়ে টুকটাক পড়ে আসতাম। আমি শুধু সুবোলকে বলতাম আমার অনেক টাকা চাই, আর সুবোল বলত হবে হবে। একদিন সুবোল বলল, ‘আরেকটা খুন করতে পারবি?’- সুবোল আমার ঘটনাটা জানত। আমি কাকে জিজ্ঞাসা করায় বলল, এক হিন্দুস্থানির বউকে, এর বেশি ও কিছু জানেনা। আমার মনে হল, হিন্দুস্তানীরা আর যাই করুক বউ মারতে চাইবেনা। সেরাতে অনেক ভাবলাম। একটা খুন করেছিলাম ঝোঁকে, আরেকটা খুন করব জেনে বুঝে! আবার মদ খেলাম, সুবোলের সাথে বসেই খেলাম, তবু মাথাটা ছাড়ল না। সুবোল তখন মাথাটা বাগে আনাতে অন্য নেশা করালো। কি বলব, সেরাতে যেন আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল, আর পাশে বসে সুবোল গীতার বাণী ওর বয়ানে বলে যেতে লাগল। আমি যেন স্বচক্ষে সেসব কথাগুলোকে রক্তমাংসের মানুষের মত দেখতে পেতে লাগলাম।
পরদিন সকালে নেশা কেটে গেলেও দেখলাম মাথায় বিবেকের কোন চাপ নেই। অন্যের বউ, সে-ই মারতে চাইছে, আমি উপলক্ষ্য মাত্র, আর গরীব আর বড়লোকদের মশাই পাপ-পূন্য নিয়ে মাথা ঘামালে চলেনা”। আবার একটা বিড়ি ধরানোর বিরতি। দেখলাম রাণা হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে নিয়ে গুটিশুটি মেরে বসেছে, অভিজিত চোখ নাচিয়ে ওর মজা বোঝালো। বিশুর নিমিলীত চোখ দেখে বুঝলাম টীকা-টিপ্পনি পরদিন পাব। চন্দনের ঐ আরেকটা খুনের ঝুলিয়ে রাখা রহস্যটা ওর নিজের গল্পের ফাঁকেও বেশ গাজর হয়ে ঝুলছে বুঝতে পারলাম।
বিড়িটা ধরিয়েই, চন্দন শুরু করল, পরদিন চলে গেলাম সুবোলের দেওয়া ঠিকানায়, ফ্রী স্কুল স্ট্রীটের কাছে একটা ছোট্ট অফিসের ভিতর এক হিন্দুস্থানি বসে আছে সুবোলের কথামতো। লোকটার গায়ে গোলগলা পাঞ্জাবি আর পাজামা, ফরসা, একটু মোটার দিকে চেহারা কিন্তু লম্বা, তবে গলার কাছে ভাঁজে ভাঁজে চর্বি কিরকম একটা বিরক্তিকর। লোকটা প্রথম প্রশ্ন করল, ‘তু বঙ্গালী হেয় ক্যায়া?’। কি ভেবে বলে দিলাম, না। লোকটা বসতে বলল। একটু বুঝে নিয়ে বলল, ‘মেরি বিবিকো মারনা হ্যায় তুঝে, পতা হ্যায় না?’। মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম জানি, বুঝলাম লোকটা সাফাই গাইবে আর আমার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা না করলেও শুনতে হবে। ‘গাড়ি চালানা আতি হ্যায় না তুঝে’-আবার মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম। লোকটা মাথা নেড়ে বলল, ‘বদচলন হ্যায় ও, বদচলন সামঝতা হ্যায় না? মেরি হি ভুল থি, বেজাত মে শাদী করলি। বঙ্গালন হ্যায় ও। ন্যশে সি চড় গয়ি থি ও দিমাগ পর। মায়া জানতি হোগী শালী। না কুছ ওউলাদ দিয়া না সুখ, উপর সে ইস পানচ সাল মে মেরা ধান্দা মন্দা হোতে যা রহা হ্যায়। শালী কি নিয়ত মে খোঁট হ্যায়’- বলে একটা ছবি ছুঁড়ে দিল টেবিলের উপর, সাথে বেশ কিছু টাকা আর একটা গাড়ির চাবি। -‘তসবীর কে পিছে অ্যাড্রেস লিখা হুয়া হ্যায় ম্যায় সব বন্দবস্ত করকে রাখখা হু। তু মেরা ড্রাইভার কে বদলী মে জায়েগা, ম্যায় বোলকে রাখখা হু কে ইহা পে মেরা কুছ ন্যায়া কাম শুরু হোনে বালা হ্যায়, অউর ইসলিয়ে কুছদিনকে লিয়ে উসে মাইকে ভেজ রহা হু। কাম খতম করকে রাসতে মে বডি ফেক দেনা, জাগাহ দেখ কে’। আমি আবার মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসছিলাম টাকা, চাবি আর ছবি নিয়ে, লোকটা পিছু ডেকে উঠল,- ‘শুন, বাকি পয়সা তেরে পাস পৌঁহছ জায়েগা, লেকিন দোবারা মুঝসে মিলনা মত, তেরা নাম নেহী পুছুঙ্গা লেকিন ইতনা ইয়াদ রাখনা কে শালী মে জাদু হ্যায়, ফিসল গ্যায়া তো নিগল জায়েগী পুরা’। আমি শুনে বেরিয়ে গেলাম’।
ক্রমশ...

No comments:

Post a Comment

কুলের আচার ও পুরাতনী চিঠি

 মনে করুন, এভাবেই সময় চলছে... তাতে তো আর জীবন কাকু থেমে থাকবে না। এগিয়েই যাবে। মনে করুন এরকম ভাবেই ২০২৫ এর বসন্ত এসে গেছে, এভাবেই ঘরে বসে কা...