সে এক দেশে ছিল এক রাজা আর ছিল তার রানী।
এই অবধি আমরা জানি।
রাজার ছিল বহুমূত্র রোগ।
করতে পারত না সুখ ভোগ
ফলত: দুর্ভোগ।
দুর্ভোগ মানে, এত বড় রাজা, যার হাতিশালে হাতি,আর ঘোড়াশালে ঘোড়া, তার বাড়িতে একটা ছেলে পুলে নেই। টাট্টু ঘোড়ায় চড়বে কে? রাজার ভেবেই বহুমূত্র রোগ চাগাড় মারে।
রাজ্যে শান্তি থাকলেও সুখ নেই, প্রজাদের সকলের মুখে কোষ্ঠ পরিষ্কার না হওয়ার দুঃখ। গ
হাসত শুধু একটা বিড়াল। বিড়ালটা রাজজ্যোতিষীর বাড়িতে থাকত মাঝে মাঝে। রাজ জ্যোতিষী একদিন মাঝরাতে উঠে দেখেন ঘরের মাঝখানে একটা কালো কুচকুচে বেড়াল ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে হাসছে। জ্যোতিষী জানতো না বেড়াল কোন দেশে পুজো হয়, তাই বুঝতেও পারেনি কোথা থেকে এল বেড়ালটা। যেই তাড়াতে গেছে, অমনি শোনে, বেড়ালটা বলছে, 'এই যাও'। বুড়ো ভাবল বুঝি ম্যাঁও করেছে ফ্যাঁস করে, কিন্তু কানে যে শুনল ‘যাও’!
কিছুদিন পর বুড়ো দেখে বিড়ালটা অঙ্ক কষছে, কাছে গেলেই বিড়াল যাও বলে তাড়িয়ে দেয়, তাই সে বাহ্যে গেলে জ্যোতিষী দেখে মাটির উপর বিভিন্ন মাপের দাগ কাটা। রাতে জ্যোতিষী বসে কুপি জ্বালিয়ে পুঁথি পড়েন অঙ্ক কষেন মঙ্গলের বক্র গতি, শনির আড়াই প্যাঁচ বুধের ঘরে, বিড়ালও অঙ্ক কষে চোখ জ্বলে তার। কদিন বুড়ো ভাবনায় অস্থির, নাওয়া খাওয়া নেই, বিড়ালটা হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘ক্যাঁও, অহ, অং ইঞা’, বুড়ো শোনে ‘ক্যায়া বাত মেরে এনেছি’, হাসে আর গড়িয়ে পড়ে যায়, আবার অঙ্ক কষে। পড়াশুনা মাথায় উঠল জ্যোতিষীর, রাজবাড়ি যায়না সাত দিন। চুলে যেদিন জট পড়ল সেদিন বিড়াল বলল, ‘ররঙ.. ব্যয়ও... য় র ল ব শ’। বুড়ো তো বিছানায় বসে তিন হাত লাফিয়ে উঠে মাথায় টাক খেয়েছে, বিড়াল বাংলা বলছে, নির্ঘাত নৃসিংহ দেব আবার ছোট করে ফিরে এসেছেন। বুড়ো আরো শুনল বিড়াল বলছে, রাজার বিয়ে, রাজার ছেলে, নতুন রানী, রক্ত গঙ্গা, দেশের মরার হাড়ের হরির লুট। শুনল তবে বুঝল কিচ্ছু না, বিড়াল কথা বলছে এই না কত! বিড়াল আরেকবার কুটিপাটি হেসে, থাবা দিয়ে মাটির অঙ্ক হিজিবিজি করে দিয়ে, বুড়োর আফিমের জলে মুখ দিয়ে বিষম খেয়ে চলে গেল, যাবার আগে যেন বলে গেল ‘আবার আসব’।
পরদিন রাজা লোক পাঠাল জ্যোতিষীকে নিয়ে আসতে। বুড়ো সেদিন মাথার জট ছাড়িয়ে ক্ষউড়ি করে রাজার বাড়িই যাবে ঠিক করেছিল। পথে যেতে যেতে শুনল রাজা শিকারে যাবার দিন জানতে চায়। বিড়ালের কথা কানে বাজে জ্যোতিষীর। পেটের কথা পেটে চেপে রাখে বুড়ো, রাতে হরীতকী ভেজানো জল খায়, বায়ু না হয় যাতে।
এদিকে রাজা সৈন্য সামন্ত, পাত্র-মিত্র, জগাই-মাধাই, বেয়াই
বোনাই নিয়ে চললেন শিকারে। এক জঙ্গল পেরুলেন রাজা, মারলেন একটা বুনোমোষ। সে ব্যাটা
বুড়ো হয়ে গেছিল, রাজার ভালোলাগলনা, রাজা পরের জঙ্গলের দিকে এগোলেন। পাত্র-মিত্রদের
পেট ব্যাথা করছিল তারা রয়ে গেল সেখানেই। পরের জঙ্গলে রাজা মারলেন একটা ভাল্লুক,
সে মধু খেয়ে পড়েছিল, রাজার তাও ভালোলাগলনা। আবার হাতঘোড়া সাজল রাজা পরের জঙ্গলে
যাবেন। সৈন্য সামন্তদের পায়ে ঝি ঝি ধরে গেল, তারা রয়ে গেল। এবার রাজা চলেন আগে
আগে, পিছনে মন্ত্রী আর কোটাল। তৃতীয় জঙ্গলে রাজা একটা হরিণ মারলেন, রাজার তীর গায়ে
নিয়ে হরিণ দিল এক ছুট। রাজা হুকুম দিলেন, ‘লে আও বাঁধকে’, কেউ গেলনা! রাজা নিজেই
নামলেন ঘোড়া থেকে। জঙ্গলের ভিতর গেলেন অনেকদুর, কোন পথে এসেছিলেন কোন পথে যাবেন
গুলিয়ে গেল। রাজা একটা নুয়ে পড়া বড় গাছ ধরে দাঁড়ালেন একটু জিরিয়ে নেবেন বলে, হঠাৎ
শোনেন একটা হাল্কা কান্নার আওয়াজ। কেউ কোত্থাও ছিলনা এই একটু আগে পর্যন্ত হঠাৎ
কাঁদে কে? তাকিয়ে দেখেন একটা মেয়ে, সুন্দরী বেশ তবে চেহারাটা বেশ বড়সর। রাজা
জিজ্ঞাসা করলেন, কে? কি বৃত্তান্ত? এই জঙ্গলে তুমি একা কেন? মেয়ে বলে, বিয়ের রাতে
তার স্বামী পিড়িতে বসার আগে মারা গেছে, তার বাড়ির লোকজন তাকে ত্যাগ করেছে, যাবার
কোথাও নেই। রাজা শুধালেন, ‘বয়স কত তোমার?’। মেয়েটি চোখের জল মুছে, রাজার চোখের
দিকে তাকিয়ে নিজের বয়স বলল। রাজা ভাবলেন, যাকে দেখেনি, শোনেনি সে মরে গেছে কোন
রোগে ভুগে তার জন্য বেচারীর কষ্ট! বললেন, ‘নিয়ে যাব তোমায় আমার রাজ্যে, সেখানে
আমার রানী আছেন, তুমি থাকবে অন্য মহলে, তোমায় রানীর মতই রাখব। কিন্তু আমার ঘোড়াটা?’
রাজা চিন্তায় পড়লেন। মেয়েটা দুটো খচ্চর জোগার করে এনেদিল।
রাজামশাই দিন তিনেক পরে, খচ্চরের পিঠে চেপে নতুন একটা
মেয়েকে নিয়ে রাজ্যে এলেন। ঢাক ঢোল, ঢ্যাঁড়া, বাদ্যি বাজনা, উলু-শঙ্খ কিচ্ছু বাজল
না। পুরনো রানী তিন দিন কিছু খেলেন না, তারপর একমাস পর নতুন মেয়েটা রাজার পাশে রাজ
দরবারে বসল আর জ্যোতিষীর আবার ডাক পড়ল। রাজা উৎসাহ ভরে জিজ্ঞাসা করলেন গ্রহ তারা
নতুন করে কি বলছে? রাজার ছেলে হবে কিনা? নতুন মেয়েটা তার হাত দেখাতে গিয়ে বুড়ো জ্যোতিষীকে
হাত দেখাতে গিয়ে নখ দিয়ে চেপে চোখ পাকিয়ে কি যেন বলতে চাইল, বুড়ো দেখল রাজার হাতে
জোড়া সন্তান, তবে পুত্রসুখে রাজা বঞ্চিত। জ্যোতিষী গণনার ফল বলে চারটি মুড়ি,
বাতাসা আর কলা পেল, খালি শেষ টুকু চেপে গেল।
রাজার ঘরে ছেলে হল, জোড়া ছেলে তবে চোখ পাকানোর ফলে আসল
রানীরও ছেলে হল আর নতুন মেয়েটার ছেলের একটু আগেই জন্মালো সে। রানীর ছেলে টুকটুকে
ফরসা লাল আপেন যেন, আর মেয়েটার ছেলের রাজার মত মুখের গড়ন তবে রঙটা কালো। নতুন
মেয়েটা ছেলেকে কোলে তুলে চোয়াল শক্ত করল। রাজা এলেন প্রহর পেরিয়ে ছোট ছেলেকে দেখতে,
দেখে আশীর্বাদ করে চলে গেলেন। কিছুদিন পর নতুন মেয়ের বাপের বাড়ির কিছু লোকেরা
রাজ্যে এল, তাদের কারোর কান কুলর মত, কারো চোখ ভাটার মত, কথা বলে চেঁচিয়ে রাজার
পাত্র মিত্র তফাৎ গেল।
এদিকে নতুন মেয়েটা একদিন কথা তুলল, সে আসার পরেই রাজা
পুত্রমুখ দেখেছেন, তাকে আর রানীর মত করে ফেলে রাখা যাবেনা। নতুন মেয়েরভাইয়ের
চেহারা শালগাছের মত, রাজার মুত্রবেগ এল, রাজা রাজি হলেন। রাজ্যে রোজ রাতে কারা যেন
খুব জোরে জোরে ফিসফাসে কথা বলে, হাওয়া থম মেরে থাকে, সকালে ঘোড়াশালে একটা ঘোড়া কম
পড়ে, কোণে একদলা রক্ত দেখতে পায় সহিস। হাওয়ায় ভুড়ভুড়ি কাটে কিছু কথা, রাজবৈদ্যর
ডাক পড়ে রাজবাড়িতে, বৈদ্য জানান রাজার নাড়ি চঞ্চল, ঘৃতকুমারীর রস মাথায় মেখে তিন
দিন ফলাহারের নিদান দিয়ে যান। রাতে ফিসফাস বাড়তে থাকে, রাখালের নধর গরুটা খোয়া যায়
একদিন, সেদিন রাজদরবার বন্ধ ছিল অনির্দিষ্ট কারণে।
এদিকে সময় গড়িয়ে যায় জ্যোতিষী হিসাব করেন, বৃহস্পতি তুঙ্গী
হয়ে কর্কটে আর রাহু মকরে অবস্থান করছে এদিকে শনি মঙ্গল একসাথে রবির ঘরে থাকতে শুরু
করেছে। সেই রাতে জ্যোতিষীর ঘুম ভাঙল স্পষ্ট ডাকে, ‘ওঠো হে, সময় তো হয়ে এল’।
জ্যোতিষী ধরমরিয়ে উঠে দেখে সেই অঙ্ক কষা বিড়ালটা মুখে একটা ফিচেল হাসি নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। জ্যোতিষী বলে,’আমার যে চারকুড়ি আয়ু লেখা আছে, সবে তো তিন কাল গেছে
তার, কি হবে আমার?’। বিড়াল বলে, ‘মোলো যা, আয়ু নিতে কে এসেছে, শুধু তোমায় নিয়ে
যাব, লাগবে তোমায় পরে, গুনে এক কুড়ি সাল কড়ে’। বুড়ো তার পুঁথি টুথি যা ছিল গামছায়
বেঁধে বিড়ালের পিছু নিল। বিড়াল বলল, ‘ঘর থেকে বেরিয়ে চোখ আর খুলবে না, যতক্ষণ না
বলছি’। বুড়ো চোখ বুজে নিল, চোখ খুলে দেখে এক পাহাড়ের উপর সে আর বিড়াল দাঁড়িয়ে, ভোর
হব হব করছে, চারিদিকে একটু শীত শীত ভাব, দূরে একটা সাদা ঘোড়া হলুদ ঘাস চিবোচ্ছে।
বেড়ালটা বললে, ‘ঠান্ডা লাগছে বুঝি? আচ্ছা আমি গরম কাপড় পাঠিয়ে দেব, এই নাও ডিম
দুখানা রাখো, ঘোড়ার ডিম, আর ঐ পাহাড়ের গুহায় থাকবে, ঘরে সবসময় আগুন জ্বেলে রেখো
একটু’। বুড়ো হাঁ করে রইল ডিম দুখানা হাতে নিয়ে। বিড়াল বলল, অত অবাক হওয়ার কিছু
হয়নি, ঘোড়ার ডিম জীবনে দেখনি তো কি হয়েছে? পক্ষীরাজ ঘোড়া কখনও দেখেছ? আবার দেখা
হবে সময় হলে’, বলে তিন লাফে ঘোড়ার পিঠে চড়ে বসল, ঘোড়া অমনি বিশ গজ পাখনা মেলে উড়ে
গেল। বুড়োর অবাক হওয়া কমার আগেই শুনতে পেল বিড়ালের গলা, ‘বিশ বছর পর তোমার কাছে
আসবে নীলকমল, সে পক্ষীরাজ ঘোড়া চাইতে আসবে’।
No comments:
Post a Comment