ব্যাডি, মানে বোধিসত্ত্ব সেন জাতে বদ্যি পেশায় বাজনদার। ও ভালো লাগল না, না? বাজনদার মানে
হল গিয়ে ডিজে। রাতের বেলা চোখে চাঁদ চশমা চড়িয়ে, আজে বাজে গানের সাথে ভালো গানের
মিশেল পাকিয়ে, মাঝে মাঝে থমকে থামিয়ে এক উদ্ভট ঘণ্ট পাকিয়ে চালায়, আর একগাদা অবোধ,
আধমাতাল ছেলেমেয়ে তাতে তাল জ্ঞানহীন জগঝম্প করে খুব মজা পায়।
না না, এসব আমার ভাবনা নয় মোটেই, এরকম ভাবে
ব্যাডির একমবেদ্বিতীয়ম বন্ধু দেবদীপ্ত ব্যানার্জী। তা ব্যাডির আজ প্রায় বছর
সাত-আটেক হল সুর্য্য দেবের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। উনি সকালে উঠে আলো দিতে বেরোন,
ব্যাডি তখন ঘুমায়, ব্যাডি সন্ধ্যেবেলা বেরোয় সুর্য্যদেব তখন পাটে যান। এককথায়
ব্যাডি নিশাচর প্রানী, সত্যিই সে রাতে চড়েই বেড়ায়।
এই অবধি ব্যাডির কথা থাক, ব্যাডিতে ফিরব আবার
তার আগে বাড়ুজ্জে বামুনের সাথে একটু পরিচয় করেনি। দেবদীপ্ত ব্যানার্জী আজীবন
স্কুলের ফার্স্ট বয়, প্রথম সারিতে বসত, ক্লাস নাইনের পর আর মাঠমুখো হয়নি, আইআইটি-র
প্রস্তুতি নিয়ে জয়েন্টে দারুণ রেজাল্ট করে এখন সে ভালো চাকুরে ইঞ্জিনিয়ার। এরকম
একটি রত্নসম ছেলের সাথে ব্যাডির প্রাণের বন্ধুত্ব হওয়া শাস্ত্রমতে অনুচিত, হতও না
যদি না এর পিছনে অন্য কারো অবদান না থাকত।
এইখানে একটু নেপথ্য কাহিনী না বলে নিলে আমার
কলম অবধি চুলকোচ্ছে। নেপথ্য কাহিনীর নায়কের নাম চতুর্মুখ, তাঁকে কেউ কোনোদিন
দেখেনি কেউ পুজোও করেন না, তিনি একগাদা অপগন্ডকে ঢেলে পৃথিবীতে পাঠিয়ে শান্তিতে আট
চোখ বুজে ঝিমুতে পারতেন, কিন্তু বুড়ো বয়স হলে যা হয় আরকি, ওঁরও ভীমরতি হল, কলির তালে নাচলেন চতুর্মুখও।
ব্যাডির বাবা কালাচাঁদ
সেন হলেন পদার্থবিদ্যার শিক্ষক, চাইলেই উনি অধ্যাপক হতে পারতেন, তবে মেরুদন্ড সোজা
না হলে মাথার পরিচর্যা করে কি হবে এই দর্শনে উনি শিক্ষকতাই বেছে নিলেন। উনি
রেজাল্ট দেখে ছাত্র ছাত্রী নেন না। ওঁর কতগুলো নিজস্ব পরীক্ষা আছে পাশ করলে তবেই
পড়ান এবং পারিশ্রমিক বাবদ ছাত্র ছাত্রীদের কিছু বই পড়তে বলেন, সেগুলো পড়তেই হয়
এটাই নিয়ম। একবার এক ক্লাশ এগারোর ছাত্রকে তার টেস্ট পরীক্ষায় ভালো নাম্বার পাওয়ায়
নিজে একটি বই উপহার দিয়েছিলেন, ‘ইন সার্চ অফ শ্রডিঙ্গার’স ক্যাট...’, বড় বড় করে
এইটাই নাম ভেবে ছেলেটি ভাবল থ্রিলার বা অ্যাডভেঞ্চারের গপ্পো হবে বুঝি কোনো,
কিন্তু পাশে একটা কোলন দিয়ে লেখা ছিল, ‘কোয়ান্টাম পিজিক্স অ্যান্ড রিয়েলিটি’ তা
খেয়াল করেনি। কালাচাঁদ বাবু আবার বই দিয়ে পড়া হল কিনা জিজ্ঞাসা করতেন, মাস দুয়েক
পর তার বাবা এসে বলেন, তার ছেলে নাকি বিজ্ঞান নিয়ে আর পড়বেনা ঠিক করেছে, এবছরটা
বসে গিয়ে সামনের বছর কলা বিভাগে ভর্তি হবে। বিরক্ত বোধ করলে কালাচাঁদ বাবুর নাক
দিয়ে নিঃশ্বাসের সাথে ঘোঁত করে একটা শব্দ বেরোয়।
তবে, দেবদীপ্ত অন্য
জাতের ছেলে কালাচাঁদ বাবুকে স্কুল কামাই করে আলাদা করে পড়াশুনা করতে হয়, এইরকম
প্রশ্নও তার কাছে মজুত থাকত। গাছেরা ত্রিমাত্রিক স্তরের বাইরের স্তর অনুভব করতে
পারে কিনা এই নিয়ে একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে সে একবার কালাচাঁদ বাবুকে ঘোঁত শব্দ করতে
বাধ্য করেছিল। কিন্তু এইখানে এইবার একটা সমস্যা এল, সবই ষড়যন্ত্র, নইলে এমন
কালাচাঁদ বাবু রুচিস্মিতা নামের আদুরে একটা মেয়েকে তার শুধু একটু ভালো করে পড়াশুনা
করতে চাওয়ার ইচ্ছায় বিনা পরীক্ষায় ব্যাচ শুরু হয়ে যাওয়ার আড়াই মাস বাদে ভর্তি নেন?
তারপরের মাসদুয়েক ও ভালোই চলেছিল, ব্যাপারটা শুরু হল তৃতীয় মাসের প্রথম শনিবারে।
কি একটা কাজে কালাচাঁদ
বাবুকে একটু বেরোতেই হল, বেরোনোর আগে বলে গেলেন, রুচিস্মিতা তুমি দেবদীপ্তর কাছ থেকে
পুরোনো পড়া গুলো একটু বুঝে নাও। এইবার আমাদের আবার একটু নেপথ্যে যেতেই হচ্ছে।
চতুর্মুখের বয়স গোনা যাবে সে ক্যালকুলেটর তো আবিষ্কার হয়নি এবার ওঁর বয়সের হিসাব
কে দেবে? আর একটা বয়সের পর বয়সে গিঁট পড়ে যায় জানেন তো, এই সময়ে শুড্ডাদের
ফকরামিতে মন যায়। তিনি ঠিক সেই সময় তীর ধনুক হাতে করে রতিভর্তা কে পাঠালেন
অকুস্থলে। মদন দেব বলেছিলেন বার বার যে, ‘দেখুন প্রজাপতি, বিজ্ঞানের ক্লাসে বান
ঠিক কাজে আসেনা’। তা ইয়ার্কির সময় কি ফাজলামি ভালো লাগে? চতুর্মুখের-ও লাগেনি।
যে সময়ের কথা হচ্ছে সে
সময়ে মোবাইল ফোন এলেও এত রমরমা হয়নি আর দেবদীপ্তর এইসব ফঙ্গবেনে জিনিসে উৎসাহও ছিল
না, কিন্তু দু সপ্তাহে রুচিস্মিতার পাশে বসা, তার না বোঝানো বুঝিয়ে দেওয়া ইত্যাদির
ফাঁকে তার হৃদি ভেসে গেল পচা গঙ্গার জলে। একদিন ফিজিক্স বই এর ফাঁকে দেবদীপ্ত একটা
চিঠি পেল, মানে ঐ দু লাইনের চিরকূট- “একটু কি তাকানো যায়না!” তলায় ছোট্ট করে লেখা ‘আর’।
হ্যাঁ দেবদীপ্তর ভাগ্যটা এরকমই ছিল। তা তারপর দেবদীপ্ত বার করলো এই আর-ই হল
রুচিস্মিতা। দেবদীপ্ত ছিল জন্মেইছিল সতেরোর ঘরের নামতা মুখস্থ করতে করতে, ও ছিল
মেঘনাথ সাহার পুনর্জন্ম, তবু কামিনী কাঞ্চনে কত মুনি ঋষি টলে গেছেন! এরকম সময় যা
হয়, ভালো ছেলেরা ইয়ে করলেও ইয়ে করতে পারেনা, তা একজন মুখপাত্র দরকার। সেই হল
ব্যাডির আগমন।
তারপর পচা গঙ্গাতেও
ফ্লো আসে মাঝে মাঝে, আর যে রাঁধে সে চুল বাধতে পারলেও ‘যে পড়ে সে করেনা’ গুরুবাণী।
কিন্তু প্রথম প্রেমের দুঃখ ফাগুনের মনখারাপের মত, স্বয়ং যোগীনাথ কয়েকযুগ মনখারাপ
করে কাটিয়ে দিয়েছিলেন, সেখানে দেবদীপ্ত তো, বেচারা! এসব ক্ষেত্রে প্রেম কেটে
বাঙ্গালী বন্ধু পায় আর প্রেম হয়ে গেলে বন্ধু বিচ্ছেদ, দেবদীপ্ত আর ব্যাডি বন্ধু হয়ে
গেল।
No comments:
Post a Comment