Thursday, July 19, 2018

একটি পরিকল্পিত হত্যা কাহিনী-৩ (শেষ)


‘পরদিন আমি সময়মত পৌছলাম ঠিকানা অনুযায়ী, বাড়ির সামনে ছোট সুন্দর একটা লাল গাড়ি দাঁড়িয়ে, অ্যাম্বাস্যাডার হবে বা ফিয়াট ও হতে পারে, আমি ঠিক গাড়ির ব্যাপারটা বুঝিনা। বেশ বড় তিন তলা বাড়ি, এক বুড়ো চাকর এসে দরজা খুলে দিল। উপরের একটা ঘর থেকে আওয়াজ এল, ‘বসতে বল দীনুদা, আমার একটু সময় লাগবে’। আমি বসলাম, বড়লোকের বাড়িতে আগে কোনোদিন আসিনি কেমন একটা হতে লাগল, চারিদিকে একটা সুন্দর গন্ধ, খুনটা আসলে কাকে করলে ভালো হয় এরকম একটা চিন্তা চলে আসছিল। হঠাৎ মনে হলো উপর থেকে কেউ যেন সরে গেল, তার মিনিট পাঁচেক পরে এক মহিলা আমায় কাঁচের গ্লাসে জল, কাপ-প্লেটে করে চা আর রকমারি বিস্কুট দিয়ে গেল, খেয়ে নিলাম আমি, ভাবতে গেলে কষ্ট হত বুঝতে পারছিলাম। তারপরও আরো মিনিট দশেক বসে ছিলাম, আরো একটু থাকলে ঠান্ডা হাওয়ায় তন্দ্রা এসে যেত এমন সময় সেই হিন্দুস্থানির বিবি নামলেন। মাথা খাটাবার মত মাথা আমার কোনকালে ছিলনা, তবু বুঝলাম এই রকম বউকে ঐরকম একটা লোক মারতে চাইছে মানে গন্ডগোল আছে। আমি ওকে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম, মহিলা আমার চেয়ে বয়সে বছর পাঁচেকের বড়ই ছিল, সিঁড়ির দুটো ধাপ আগে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘গাড়ি চালাতে জানো?’, আমি সেই আগের মত মাথা নেড়েই কাজ চালালাম। গাড়িতে উঠলাম, স্টার্ট দিলাম, গাড়ি চলল। তখন কলকাতায় গাড়িঘোড়া খুব বেশি ছিলনা, খানিকটা যাবার পর মহিলা আমায় উদ্দেশ্য না করেই বলে উঠল, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছো জানো?’, চালাতে চালাতেই না তাকিয়ে মাথা নাড়লাম ছোট করে। আবার কথা বলল, ‘এর আগে কোথায় গাড়ি চালাতে?’, কি উত্তর দেব বুঝতে পারছিলাম না। আর আমার মেয়েদের সাথে কথা বলতে খুব ভালোলাগত না, কি সমস্যা ছিল আমি জানিনা, তার উপর এই সুন্দরী মহিলার গা থেকে এক মিষ্টি গন্ধ আমার বিরক্তই লাগছিল। আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কি?’, আমি আবারও চুপ করে রইলাম। ‘অ্যাই তুমি বোবা নাকি?’, একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিল মহিলা, এবার বলতেই হত, খুন করতে যাচ্ছি কি নাম বলি? সুবল নামটাই মনে এল। ‘যাক বাবা, বোবা নও তাহলে, আমি আগেই একবার কথা বলে নিতে চেয়েছিলাম, তোমার সাহেব বললেন, তিনি ঠিক বুঝে নেবেন। এমন সময় নন্দদার মা মারা গেল! নন্দ আমাদের গাড়ি চালায় ১৩ বচ্ছর ধরে চালায় জানো। আমি বললাম ও ফিরে আসুক তারপর যাবো, তিনি বললেন এদের বয়স হয়ে গেলে নাকি এসব মিথ্যে বলে কিছু টাকা নিয়ে দেশে চলে যায় আর ফেরে না, কিন্তু ওর ট্রাঙ্ক টাঙ্ক সব ওর ঘরেই পড়ে আছে...’, মহিলা বলে চললেন, আমার মাথায় খুনের ছকটা পরিষ্কার হয়ে এল, পুরোনো ড্রাইভারকে সরিয়ে দিয়ে, নতুন ড্রাইভার তাও একদিনের জন্য, এদিকে মারবার কারণটা ভাবলে আর মহিলাকে দেখলে আবার দুটো মিলছে না। ‘অ্যাই ছেলে, কি নাম যেন তোমার?’- মহিলার ডাকে আবার চটকটা ভাঙল। সুবল, বললাম আমি, ‘তুমি এত কম কথা বল কেন বলোতো? আমি চুপ করে থাকতে পারিনা, তাই তো বাড়ির কাজের লোকগুলোকে সব বাঙালী রেখেছি। তোমার সাহেব তো বাড়িতেই থাকেনা, সারাদিন ইয়ে কাম, উয়ো ধান্দা এই জন্যেই তো আমায় সরিয়ে দিতে চাইছে।’, বলে একটু চুপ করল, আমি একটু আড়চোখে চেয়ে নিলাম সরিয়ে দিতে চাইছে শুনে। এরপর বেশ কিছুক্ষণ একদম চুপ।
গন্ধটা আমার তাড়িয়ে বেড়ালেও বুঝতে পারছিলাম না সেটা ঐ মহিলার গায়ের গন্ধ না বাইরের, তবে ভাবলাম বোধহয় এবার ক্ষান্ত হল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা কথা আমাকে আবার নাড়িয়ে দিল, ‘আমি জানি তুমি আমাকে মারতে এসেছ’- এবার গলার আওয়াজটা অনেক মাপা এবং শান্ত। আমি ঘুড়ে তাকাতে গিয়ে নিজেকে আটকে নিলাম কিন্তু শরীরটা একটু কেঁপে উঠল। মহিলা ঐ শান্ত ভাবেই বলতে লাগল, ‘এটা অনেকদিন ধরে সাজানো, নন্দদা এসে ছুটি চাইতেই আমি বুঝতে পারি সে মিথ্যে বলছে। আমি জানো কেউ মিথ্যে বললে একটা গন্ধ পাই’। ইচ্ছা করছিল নাম বলার সময় পেয়েছে কিনা জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু পারিনি। ‘তোমার সাহেব’- বলে আবার বলতে শুরু করল, ‘আগে আমায় সব জায়গায় নিয়ে যেত, সব কথা বলত, কিন্তু কিছুদিন যাবত আমায় একটু এড়িয়েই চলছে, জিজ্ঞেস করলেই মিথ্যে বলছে। এই লোকটাই ওর বাড়ির বাড়ির বিরুদ্ধে গিয়ে আমায় বিয়ে করে, আমার বাড়িরও মত ছিলনা কিন্তু অদ্ভুত একটা আকুতি দেখেছিলাম ওর মধ্যে, সেই লোকটা এখন দিনের পর দিন রাতে বাড়ি ফেরেনা, মানে ওর নিজের বাড়িতেই থাকে, ওর মা আমায় মেনে নেয়নি বলে এই বাড়িটা আমায় করে দিয়েছিল। দু-চারদিন আগে যখন এসে বলল ব্যবসার কাজে নাকি বেশ কিছু বাইরের লোক এই বাড়িতে আসবে তাই আমি বাপের বাড়ি গেলে ওর সুবিধা হয়। আমি স্পষ্ট মিথ্যে বুঝতে পারলাম কিন্তু কিছু বলিনি কি বলব?’- একটু যেন গলাটা কেঁপে উঠল মহিলার, আমি এসব কথার মধ্যে খালি ভাবছিলাম হিন্দুস্থানি ব্যবসায়ীর কথা, হঠাৎ বলে উঠল, ‘একটু দাঁড় করাও না গাড়িটা চা খাব’। আমার উপর নির্দেশ ছিলনা এরকম পরিস্থিতিতে কি করব, কিন্তু কেন জানিনা মনে হল মহিলা আরো কিছু বলতে চায়, দাঁড় করালাম একটা ধাবা দেখে’। মদের বোতলটা তুলে চুমুক দিতে গিয়ে দেখে মদ নেই, কথকের নেশার বস্তুর অভাবে আমরা একটু ইতঃস্তত বোধ করলেও, চন্দন, ‘আরেকটা ভালো সিগারেট দিন বলে গল্পটা আবার আরম্ভ করে দিল, পয়সা নিতে গিয়ে আবার দেখলাম, মহিলা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, আমি চেয়েও ঝট করে চোখটা সরিয়ে নিতে পারলাম না, আমার হাত থেকে চা নিতে নিতে মহিলা বলল, ‘তুমি পারবে আমাকে মারতে?’ যেন খুব মজার একটা জিনিস হতে চলেছে।– ‘দেখো খুব একটা কষ্ট দিওনা একটা গুলি টুলি করে যদি, কিন্তু তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছেনা তুমি মানুষ মারতে পারবে,’ আমি কোনোদিনও এত সুন্দরী কোনো মহিলার এত কাছে আসিনি, কল্পনাও করিনি, কথা বলা তো দূরে থাক। চা নিয়ে এলাম, খেতে খেতে এত কথা বলছিল মহিলা যে আমারও ইচ্ছা করছিল কিছু বলি, কিন্তু কি বলতে হয় জানিনা বলে চুপ ছিলাম। চা খাওয়া শেষ হলে আমি গাড়িতে উঠতে যেতেই মহিলা বলে উঠল, ‘কি দিয়ে মারবে বললেনা তো’, আমি যেন রোজ সকাল বিকাল খুন করে উঠে জলখাবার খাই এভাবে জিজ্ঞাসা করল, আমি চুপ করেই থাকলাম। মহিলা একটু এগিয়ে এসে, গন্ধটা আরো নাকে লাগিয়ে দিয়ে আমার মুখটা দেখে বলল, ‘আহারে বাচ্চা ছেলে, কি যেন নাম বলেছিলে?’- এবার কেন জানিনা আসল নামটাই বললাম, অদ্ভুতভাবে হাসল নামটা শুনে, তারপর বলল ‘আমি একটু গাড়ি চালাই?’ আমি একটু অবাক হয়ে তাকাতেই আবার একটু হেসে আমার হাত থেকে চাবির গোছাটা নিয়ে নিয়ে বলল ‘চালাতে জানি আমি, দেয়না চালাতে। শেষ ইচ্ছাই মনে করো’, আমি চেয়েও কিছু বলতে পারলাম না আর ঠিক সেই সময় হিন্দুস্থানির সাবধানবাণী কানের মধ্যে, “...শালী মে জাদু হ্যায়, ফিসল গ্যায়া তো নিগল জায়েগী পুরা” চমকে উঠলাম নিজের মধ্যেই’। এই অবধি বলে থেমে গেল নিজের মনেই যেন কি একটা ভাবতে লাগল, ভাবলাম বিড়ি টিরি ধরাবে হয়ত। রাণা বলে উঠল, ‘তারপর কি হল?’। চমক ভেঙে হালকা একটু হেসে উঠল চন্দন, বলল, ‘সুবল, আমাকে প্রায়ই বলত মাল খেয়ে যে, ‘ধান্দার সময় প্রেম করবি না, প্রেমের সাথে ধান্দা করবি না’। প্রেম আমার আসত না বলে কথাটা নিয়ে আমি আর ভাবিনি কখনও, তবে সেই সময় দাঁড়িয়ে, সুবল আর হিন্দুস্থানির সব কথা আমি জলের মত বুঝে গেলাম। কষ্ট হচ্ছিল সেই সময়, আরেকটু সময় পেলে যেন ভালো হত। মনে মনে ভাবলে দেখি গোয়েন্দা পুলিশরা অনেক খুনীদের নিয়ে হিমশিম খেয়েছে, আমি চাইলেই তাদের মাথায় আরেকটা বোঝা বাড়াতে পারতাম। আমার পকেটে একটা বন্দুক ছিল আর নিয়েছিলাম খানিকটা বিষ, মহিলা কষ্ট সেরকম পায়নি তবে লাশটা ফেলে দেবার আগে দেখেছিলাম ঠোঁট নীল হয়ে গেছে, গন্ধটা আরো একবার পেয়েছিলাম। গাড়িটা একটা জায়গায় ধাক্কা মেরে সামনের দিকটা তুবড়ে দিয়ে ফেলে রেখে চলে গেছিলাম। এরপর আর সুবল বা কারোর সাথে দেখা করিনি আর, কি হল তার খবরও নিইনি’, পুরোপুরি থেমে গেল চন্দন, বুঝলাম গল্প শেষ।
অশরীরী নিয়ে শর্টফিল্ম করা হয়নি আমাদের তবে একটা গল্প পেয়েছিলাম নিঃসন্দেহে। বিশুর পরদিন দাবি ছিল ঐ অঞ্চলে চন্দন নামে নাকি কেউ থাকেনা, কেউ দেখেওনি ঐ চেহারার লোককে। অকারণ একটা গল্প দিয়ে গেল, চন্দন হোক বা কোন অচেনা অশরীরী!

No comments:

Post a Comment

কুলের আচার ও পুরাতনী চিঠি

 মনে করুন, এভাবেই সময় চলছে... তাতে তো আর জীবন কাকু থেমে থাকবে না। এগিয়েই যাবে। মনে করুন এরকম ভাবেই ২০২৫ এর বসন্ত এসে গেছে, এভাবেই ঘরে বসে কা...